ভালো হয়ে যাও মাসুদ এবং কোহলবার্গ-এর নৈতিক বিকাশের ৬টি ধাপ

গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম জনপ্রিয় মুখ হান্নান মাসুদ কি নায়ক থেকে ওবায়দুল কাদেরের মাসুদ হয়ে যাচ্ছে? মানুষের নৈতিক বিকাশ কীভাবে হয়?

মনোজগত

২১ মে, ২০২৫

July Uprising Hero Hannan Masud & Kohlberg's Moral Development Theory. Cover image for the blog 'ভালো হয়ে যাও মাসুদ এবং কোহলবার্গ-এর নৈতিক বিকাশের ৬টি ধাপ' on zibonthinks.framer.ai by Khalid Hasan Zibon (খালিদ হাসান জীবন এর ভাবনা, ব্লগ)
July Uprising Hero Hannan Masud & Kohlberg's Moral Development Theory. Cover image for the blog 'ভালো হয়ে যাও মাসুদ এবং কোহলবার্গ-এর নৈতিক বিকাশের ৬টি ধাপ' on zibonthinks.framer.ai by Khalid Hasan Zibon (খালিদ হাসান জীবন এর ভাবনা, ব্লগ)

রাত ৩টার সময় কফি ব্রিউ করতে গিয়ে হঠাৎ হান্নান মাসুদের থানা-কাণ্ড নিয়ে ভাবছিলাম। ভাবনাকে তো আমরা দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসি না, এমনিতেই উঁকি দেয়!

আমি ভাবছিলাম জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম একজন নায়ক হান্নান মাসুদ কীভাবে ধীরে ধীরে সামালোচকদের "মংলা মাসুদ" হয়ে উঠছেন, কীভাবে একজন গাড়ি দিলেই নিয়ে নিচ্ছেন, এবং কীভাবে নিজের প্রভাব খাটিয়ে থানা থেকে আটক ব্যক্তিদের ছাড়িয়ে আনছেন।

তার সম্পর্কে এর মধ্যেই একটা পার্সেপশন তৈরি হয়েছে যে তার মধ্যে সততার অভাব আছে। আমার নিজেরও একই দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে তার সম্পর্কে। একটু আগে আলোচিত বিষয়গুলোতে হান্নান মাসুদের অন্যায় কতটুকু বা খবরগুলোর পেছনের ঘটনা কী আমি জানি না, তবে পার্সেপশন এক জিনিস আর সত্য আরেক জিনিস। সাধারণ মানুষের পার্সেপশন আসলে সবসময় সত্যের ধার ধারে না।


July Uprising Hero Hannan Masud & Kohlberg's Moral Development Theory. Hannan Masud Dhanmondi Thana | হান্নান মাসুদ, ধানমন্ডি থানা | Skeptick | স্কেপটিক | Image for the blog 'ভালো হয়ে যাও মাসুদ এবং কোহলবার্গ-এর নৈতিক বিকাশের ৬টি ধাপ' on zibonthinks.framer.ai by Khalid Hasan Zibon (খালিদ হাসান জীবন এর ভাবনা, ব্লগ)


হান্নান মাসুদের এই নৈতিক অবস্থান এবং তা নিয়ে জনমনে তৈরি হওয়া ধারণা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই আমার মনে প্রশ্ন উঁকি দেয় – একজন মানুষের নৈতিকতা কীভাবে গড়ে ওঠে? কেন কেউ কেউ সময়ের সাথে সাথে আদর্শচ্যুত হয়, আবার কেউ কেউ কঠিন পরিস্থিতিতেও নৈতিকভাবে দৃঢ় থাকে? এই প্রশ্নগুলোই আমাকে টেনে নিয়ে যায় লরেন্স কোহলবার্গের নৈতিক বিকাশের তত্ত্বের দিকে, যা আমি বছরখানেক আগে বেশ আগ্রহ নিয়ে পড়েছিলাম।

ভালো-মন্দ বিচার করে সঠিক যুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে নৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়াই হলো নৈতিক বিকাশ।


মানুষের নৈতিকতা কীভাবে গড়ে ওঠে?

এই প্রশ্নটি বাবা-মা, ধর্মীয় নেতা এবং দার্শনিকদের বহুকাল ধরে ভাবিয়েছে। তবে এখন নৈতিক বিকাশ মনোবিজ্ঞান ও শিক্ষার ক্ষেত্রেও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। যেমন:

  • বাবা-মার প্রভাব নাকি সমাজের প্রভাব নৈতিক গঠনে বেশি কাজ করে?

  • সব শিশু কি একইভাবে নৈতিকতা শেখে?


কোহলবার্গ-এর নৈতিক বিকাশ তত্ত্ব

মার্কিন মনোবিজ্ঞানী লরেন্স কোহলবার্গ এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার জন্য একটি বিখ্যাত তত্ত্ব দিয়েছেন, যা "নৈতিক বিকাশ তত্ত্ব" বা Theory of Moral Development নামে পরিচিত। তিনি সুইস মনোবিজ্ঞানী জঁ উইলিয়াম ফ্রিৎজ পিয়াজে-এর কগনিটিভ ডেভলপমেন্ট থিওরিকে আরও বিস্তৃত করে দেখান যে, নৈতিক বিকাশ একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া যা সারা জীবন চলতে থাকে।

কোহলবার্গ তার "নৈতিক বিকাশ তত্ত্বে" আলোচনা করেছেন কীভাবে মানুষের ৩টি স্তরের ৬টি ধাপে নৈতিক বিকাশ ঘটে।


👶 প্রাক-সামাজিক স্তর
  • ধাপ ১: আজ্ঞাবহতা এবং শাস্তিকেন্দ্রিক
    এই ধাপে, মানুষ মনে করে যে ভালো হওয়ার অর্থ হলো শাস্তি এড়ানো। তারা নিয়ম মেনে চলে শুধুমাত্র শাস্তির ভয়ে।

    উদাহরণ: একটি শিশু বাবার পকেট থেকে টাকা চুরি করা থেকে বিরত থাকলো, কারণ এর আগেরবার সে চুরি করার অপরাধে শাস্তি পেয়েছিলো।


  • ধাপ ২: ব্যক্তিস্বার্থ বা বিনিময়কেন্দ্রিক
    এখানে, লোকেরা নিজেদের স্বার্থের জন্য সিদ্ধান্ত নেয়। তারা নিয়ম মানবে যদি তাতে তাদের লাভ হয়।

    উদাহরণ: একটি শিশু তার খেলনা বন্ধুর সাথে শেয়ার করে, কারণ সে আশা করে যে বন্ধুও তার খেলনা একইভাবে তার সাথেও শেয়ার করবে।


Kohlberg's Six Stages of Moral Development explained in Bangla. Infographic showing the 6 steps of Lawrence Kohlberg’s theory in Bengali, used in the blog 'ভালো হয়ে যাও মাসুদ এবং কোহলবার্গ-এর নৈতিক বিকাশের ৬টি ধাপ' on zibonthinks.framer.ai by Khalid Hasan Zibon (খালিদ হাসান জীবন এর ভাবনা, ব্লগ)। কোহলবার্গ-এর নৈতিক বিকাশের ছয়টি ধাপ বাংলায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে এই ইনফোগ্রাফিকে। ব্লগ 'ভালো হয়ে যাও মাসুদ এবং কোহলবার্গ-এর নৈতিক বিকাশের ৬টি ধাপ' এ ব্যবহৃত একটি বাংলা চিত্র।


👨 সামাজিক স্তর
  • ধাপ ৩: "গুড বয়" টাইপ আচরন-কেন্দ্রিক
    এই ধাপে, লোকেরা অন্যদের কাছ থেকে ভ্যালিডেশন পেতে চায়। তারা নিয়ম মানে যাতে পরিবার বা বন্ধুরা তাদের ভালো মনে করে।

    উদাহরণ: একটা ছেলে সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফেরে, কারণ এর ফলে সবাই তাকে ভালো বলে।


  • ধাপ ৪: সামাজিক ব্যবস্থা বজায় রাখা
    এই ধাপে, লোকেরা আইন ও নিয়ম মানে কারণ তারা বিশ্বাস করে এটি সমাজকে সুষ্ঠু রাখে।

    উদাহরণ: রফিক ভাই ট্রাফিক আইন মানেন, কারণ তিনি মনে করেন তিনি নিজে ট্রাফিক আইন মানলে সমাজে শৃঙ্খলা বজায় থাকবে, অন্যরাও মানবে।


🧓 উত্তর সামাজিক স্তর
  • ধাপ ৫: সামাজিক চুক্তি এবং ব্যক্তির অধিকার
    এখানে, লোকেরা আইনকে সমাজের একটি চুক্তি হিসেবে দেখে, যা প্রয়োজনে পরিবর্তন করা যায়। তারা ব্যক্তিগত অধিকার ও সামাজিক মূল্যবোধ মানে।

    উদাহরণ: ইরন ভাই মিডিয়ার নিঃশর্ত স্বাধীনতা চান, কারণ তিনি মনে করেন গণমাধ্যমের স্বাধীনতা একটা জবাবদিহিমূলক সমাজের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।


  • ধাপ ৬: সর্বজনীন নৈতিকতা
    এই সর্বোচ্চ ধাপে যারা পৌঁছান, তাদের নিজস্ব কিছু নীতি থাকে। যেমন – ন্যায়বিচার, সমতা, মানবিকতা, সর্বোচ্চ সততা, ইত্যাদি। তারা তাদের নীতির বাইরে যান না। এমনকি সেটা নিজের স্বার্থ তো বটেই, প্রচলিত আইনের বিরুদ্ধে গেলেও!


    তার নৈতিকতার জন্য কোন ধরণের প্রভাবের প্রয়োজন হয় না, যেমন – ধর্ম, রাষ্ট্র, আইন, সুবিধাপ্রাপ্তি বা অন্য কিছু। তিনি চিন্তা করেন না যে আমি খারাপ কাজ করলে দোযখে যাবো, তাই করবো না; আইনে বলা আছে তাই আমাকে এটা মানতে হবে, বা এই ভালো কাজটা করলে পরবর্তীতে আমি নিজেও সুবিধা পাবো, তাই করবো। তিনি ভালো কাজ করেন, নৈতিক থাকেন, কারণ তিনি বিশ্বাস করেন একমাত্র সেটাই সঠিক পথ।


    উদাহরণ: এডওয়ার্ড স্নোডেন যখন দেখলেন তারই নিজের গোয়েন্দা সংস্থা তার দেশের সাধারণ নাগরিকদের অজ্ঞাতসারে তাদের ওপর নজরদারি করছে, তখন তিনি সেই তথ্য সারা বিশ্বের কাছে প্রমানসহ প্রকাশ করে দিলেন। যদিও তিনি জানতেন যে এর ফলে তিনি আইন ভাঙছেন এবং নিজের জীবনকে কঠিন ঝুঁকিতে ফেলছেন! কারণ? এটা তার ব্যক্তিগত নীতির সাথে যায়নি। তিনি বিশ্বাস করতেন এটা অন্যায়।


Edward Snowden sitting with his laptop. A symbolic image representing privacy, surveillance, and whistleblowing, used in the blog on zibonthinks.framer.ai by Khalid Hasan Zibon (খালিদ হাসান জীবন এর ভাবনা, ব্লগ)। এডওয়ার্ড স্নোডেন ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছেন। প্রাইভেসি, নজরদারি এবং হুইসেলব্লোয়ার ভাবনার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত একটি চিত্র, zibonthinks.framer.ai ব্লগে খালিদ হাসান জীবন এর লেখায়।


কোহলবার্গ-এর এই তত্ত্ব সমালোচনার উর্ধ্বে নয়

কোহলবার্গের তত্ত্ব বেশ শক্তিশালী হলেও এটি সমালোচিত হয়েছে বিভিন্ন কারণে।


পশ্চিমা-পুরুষ কেন্দ্রিক

কোহলবার্গের গবেষণা শুধু আমেরিকান ছেলেদের উপর করা হয়েছিল। অনেক সমালোচক বলেন, নারীদের ক্ষেত্রে বা অন্যান্য সংস্কৃতিতে নৈতিকতা ভিন্নভাবে বিকশিত হয় (যেমন: সম্পর্ক রক্ষাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া)।


উদাহরণ: ভারতে বা বাংলাদেশে সমষ্টিগত সমাজ (Collective Culture) থাকায় পরিবার/সমাজের চিন্তা ব্যক্তিগত স্বার্থের চেয়ে বেশি প্রভাব ফেলতে পারে।


"যুক্তি" বনাম "আচরণ"-এর পার্থক্য

কোহলবার্গ শুধু কীভাবে মানুষ নৈতিক সমস্যা নিয়ে যুক্তি দেয় সেটা দেখেছেন, কিন্তু তাদের আচরণ কি আসলে তেমন হয় কিনা তা পরীক্ষা করেননি।


উদাহরণ: কেউ বলতে পারে "চুরি করা অন্যায়", কিন্তু বাস্তবে প্রয়োজনে সে নিজেই চুরি করতে পারে!


ধর্ম ও সংস্কৃতিকে উপেক্ষা

তাঁর তত্ত্বে ধর্ম, ঐতিহ্য বা স্থানীয় মূল্যবোধের প্রভাব কম দেখা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশে ধর্মীয় নৈতিকতা (যেমন: আল্লাহ্ কি বলেছেন?) অনেকের জন্য প্রধান ভূমিকা রাখে।


অতিসরলীকরণ

নৈতিক বিকাশকে ৬টি কঠিন স্তরে ভাগ করা হলেও, বাস্তবে মানুষের চিন্তা আরও জটিল ও পরিস্থিতি-নির্ভর।


উদাহরণ: একই মানুষ বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন স্তরের যুক্তি দিতে পারে, যেমন: কখনো আইন মেনে চলা, কখনো বিবেকের ডাকে সাড়া দেওয়া।

অতিসরলীকরণ নিয়ে আমার আরেকটি লেখা পড়তে পারেন এখানে: সত্য, আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, এবং সরলীকরণ


শিশুদের সীমিত ধারণা

কোহলবার্গের তত্ত্বে শিশুরা জটিল নৈতিক সমস্যা বুঝতে পারে ধরে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু অনেক গবেষক বলেন, ছোট শিশুরা প্রায়ই শাস্তি/পুরস্কার দিয়েই নৈতিকতা বোঝে।


বয়স, অভিজ্ঞতা, এবং উচ্চশিক্ষা সর্বোচ্চ ধাপে পৌঁছানোর গ্যারান্টি দেয় না

আমরা সমাজে বয়স্ক, উচ্চশিক্ষিত, এবং অনেক ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ কিন্তু অসৎ মানুষকে দেখি না? আমাদের সমাজে তো এটাও প্রচলিত আছে যে শিক্ষিতরা বেশি দুর্নীতি করে! এটার কারণ হচ্ছে বয়স, অভিজ্ঞতা, বা উচ্চশিক্ষা মানুষকে নৈতিক উন্নয়নের সর্বোচ্চ ধাপে পৌঁছানোর গ্যারান্টি দেয় না। তবে কেউ যদি সিদ্ধান্ত নেয় বা আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে যে সে নৈতিকতার সর্বোচ্চ ধাপে পৌঁছাতে চায়, তাহলে তার কী করণীয়?


নৈতিক দৃঢ়তা অর্জনের পথে কিছু পদক্ষেপ:

  1. একদম ছোটবেলা থেকেই ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং এবং নৈতিক শিক্ষা দরকার।

  2. শুধু নিজের সুবিধা বা অন্ধভাবে নিয়ম মানার বাইরে গিয়ে যুক্তি দিয়ে সবকিছু বিচার করার অভ্যাস গড়ে তোলা প্রয়োজন।

  3. আপনাকে ভাবতে বাধ্য করে, এমন সব বই বা লেখা পড়া, ভিডিও দেখা, কথা শোনা, ইত্যাদি।

  4. সহমর্মিতা বাড়ানোর চেষ্টা করা, অন্যদের দিক থেকেও প্রতিটা জিনিস দেখা চেষ্টা করা।

  5. মানুষের সাথে কথা বলা, তাদের গল্প শোনা – যা আপনার সামনে হয়তো নতুন ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে!

  6. আপনার পছন্দ না এমন মতামতও সহ্য করার ক্ষমতা তৈরি করা, পরমতসহিষ্ণুতা চর্চা করা।

  7. সুস্থ আলোচনা বা বিতর্ক করা; মানুষকে ব্যক্তিগত আক্রমণ না করে তারা যা বলছেন সেটার যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা। অর্থাৎ আপনার সাথে আলোচনা করাটা যেন অন্যরা নিরাপদ মনে করে!

  8. কর্তৃপক্ষকে প্রশ্ন করার স্বাধীনতা দেওয়া বা প্রশ্ন করার অধিকার আদায় করার চেষ্টা করা। যেখানে প্রশ্ন করলে শাস্তি পেতে হয়, সেখানে মানুষ নিচু স্তরেই আটকে থাকে।

স্তর ৫ বা ৬-এ পৌঁছানো মানেই সেখানে স্থির থাকা নয়। ভয়, চাপ বা বিপদের সময় মানুষ আবার পিছিয়ে যেতে পারে। লক্ষ্য হলো নৈতিক দৃঢ়তা গড়ে তোলা, যাতে কঠিন সময়েও নীতি অনুসারে চলা যায়।

ধরুন, ছোটবেলায় যেসব প্রয়োজন ছিলো, সেসব আমরা পাইনি। তাহলে?

তাহলে এখন থেকে সচেতনভাবেই চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সেই পরিবেশটা দেওয়াই হওয়া উচিৎ আমাদের লক্ষ্য।


নৈতিকতা বিকাশে কাদের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ?

নৈতিক বিকাশের ক্ষেত্রে পরিবার, বিশেষ করে বাবা-মা, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কোহলবার্গের তত্ত্ব অনুসারে, প্রাক-সামাজিক স্তরে (ধাপ ১ এবং ২), শিশুরা বাবা-মা এবং শিক্ষকদের বেঁধে দেওয়া নিয়ম মেনে চলে শাস্তি এড়াতে বা পুরস্কার পেতে। এই ধাপে, শিশুরা নিজস্ব নৈতিক বোধ গঠন করে না, বরং বাবা-মায়ের কাছ থেকে শেখে।

উদাহরণস্বরূপ, একটি শিশু মিথ্যা বলা থেকে বিরত থাকে কারণ সে জানে যে তার বাবা-মা তাকে শাস্তি দেবেন।

সামাজিক স্তরে (ধাপ ৩ এবং ৪), শিশুরা বাবা-মা এবং সমাজের অনুমোদন পেতে চায়। তারা নিয়ম মানে যাতে তাদের পরিবার এবং সমাজ তাদের ভালো মনে করে।

উদাহরণস্বরূপ, একটি মেয়ে স্কুলের নিয়ম মানে যাতে তার বাবা-মা তাকে "ভালো মেয়ে" বলে। এই ধাপে, বাবা-মা শিশুদের সামাজিক নিয়ম এবং দায়িত্ববোধ শেখান।

অন্যান্য প্রভাবকারী এজেন্সির মধ্যে রয়েছে স্কুল, শিক্ষক, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, এবং সমবয়সী বন্ধুরা। তবে, এটা আমরা হয়তো সবাই স্বীকার করি, এবং বিভিন্ন গবেষণাও প্রমাণ দেয় – পরিবার, বিশেষ করে বাবা-মা, শিশুদের প্রাথমিক নৈতিক বোধ গঠনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে।


জীবন থেকে নেওয়া ছোট একটা ঘটনা

নৈতিকতায় বাবা-মায়ের ভূমিকা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই আমার হঠাৎ আব্বার কথা মনে পড়লো। আমার আব্বা গালি দেওয়াটা খুব অপছন্দ করতেন, এমনকি সামান্য "শালা" বলে গালি দেওয়াটাও! ছোটবেলায়, আমাদের গ্রামে আমার সমবয়সীদের মধ্যে গালি দেওয়ার ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক ছিলো, কিন্তু আমার জন্য ছিলো কড়া নিষেধাজ্ঞা। তারপরেও, একদিন আমার খুব ইচ্ছা হলো আমিও কাউকে গালি দেবো!

আমাদের বাড়ীর সামনের রাস্তা দিয়ে এক লোক সাইকেলে করে যাচ্ছিলো, আমি রাস্তায় আরেকজনের সাথে খেলছিলাম। উনি পাশের গ্রামেরই লোক, আমিও ওনার চেহারা চিনতাম, উনিও আমাকে ভালো করেই চিনতেন! আমি একদম কোন কারণ ছাড়াই হঠাৎ "এই শালা" বলে গালি দিয়ে বসলাম! সেই লোক সাইকেল থামিয়ে নামলো, চিৎকার-চেঁচামেচি করলো! ছোট্ট একটা গালির কারণে ছোটখাটো একটা শোরগোল শুরু হয়ে গেলো!

আব্বা যখন এই কথা জানলেন, একেবারে মারতে উদ্যত হলেন! আমার আব্বা ছোটবেলায় ছিলেন মায়ের শাসনের হাত থেকে বাঁচার অবলম্বন! এখন বয়স বাড়ার সাথে সাথে অনেককিছুর পরিবর্তন ঘটলেও ছোটবেলায় উনি সহজে বকাঝকাও করতেন না! সেই মানুষ যখন মারতে উদ্যত হলেন তখন সেটা আমার মনে বেশ ভয় ধরিয়ে দিলো! আমি বুঝে গেলাম যে এই কাজটা আর করা যাবে না, শাস্তি পেতে হবে!

কোহলবার্গের তত্ত্ব অনুযায়ী, এটা ছিল নৈতিক বিকাশের প্রথম ধাপ – ‘আজ্ঞাবহতা এবং শাস্তিকেন্দ্রিক’ আচরণের একটি পরিষ্কার উদাহরণ। শাস্তির ভয়েই সেদিন আমি সেই মন্দ কাজটি থেকে বিরত থাকতে শিখেছিলাম।

তখন থেকে গালি সহজে আমার মুখে আসে না। তারপর কখনোই যে মুখে গালি আসেনি এমন দাবি করবো না। অনেক সময় বন্ধুদের সাথে ব্যক্তিগত পরিসরে বা আড্ডায় কোন কোন প্রসঙ্গে হয়তো এসেছে। কিন্তু তারপর থেকে আর প্রকাশ্যে কখনো কাউকে গালি দেইনি। এখন চেষ্টা করলেও আমার পক্ষে আর কাউকে গালি দেওয়া সম্ভব না।

বরং টিনএইজে কিছু কৌশল রপ্ত করেছিলাম, যেন গালি দিলেও সেটা গালির মতো না শোনায়! যেমন আমাদের অঞ্চলে প্রচলিত একটা গালি ছিলো "শালার ব্যাটা", সেটাকে কৌশলে যদি "শ্যালকপুত্র" বলি তাহলে আর একইরকম শোনায় না।

যাই হোক, তারপর আমার মনে পড়লো, আব্বার সাথে আমার কাটানো সময়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল স্মৃতি হয়ে আছে – আব্বার সাইকেলের সামনে চড়ে কোথাও যাওয়া। শুক্রবারে জুমআ'র নামায পড়তে, বাজারে, অথবা অন্য কোন কাজে কোথাও যাওয়ার মুহুর্তগুলো আমার মনে পড়লো। কারণ, আমি পুরো রাস্তাজুড়ে আব্বাকে শুধু অবিরত প্রশ্ন করতেই থাকতাম, আর আব্বা বিরক্ত না হয়ে উত্তর দিয়েই যেতেন!


An illustration showing a child sitting on the front bar of a bicycle while his father rides it. The text in the image reads: "ছোটবেলায় আপনার বাবার সাথে কাটানো কোন সময়টা আপনার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে?" Used in a reflective blog post on zibonthinks.framer.ai by Khalid Hasan Zibon (খালিদ হাসান জীবন এর ভাবনা, ব্লগ)। একটি ছবি যেখানে একটি শিশু সাইকেলের সামনে বসে আছে এবং বাবা সাইকেল চালাচ্ছেন। ছবিতে লেখা: "ছোটবেলায় আপনার বাবার সাথে কাটানো কোন সময়টা আপনার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে?" zibonthinks.framer.ai ব্লগে খালিদ হাসান জীবন এর লেখা একটি স্মৃতিমূলক ও চিন্তনধর্মী পোস্টে ব্যবহৃত।


আমি নিজেও এখন এক সন্তানের জনক। আমার ছেলেও সারাদিন প্রশ্ন করে। এখন আমি বুঝি যে আমার কৌতূহল বাঁচিয়ে রাখার জন্য আব্বার এই ধৈর্যটা কতো জরুরী ছিলো! কারণ, শিশুরা তাদের প্রশ্নের উত্তর না পেলে, বা প্রশ্ন করতে নিরুৎসাহিত হলে তাদের কৌতূহল মরে যায়। এটি পরোক্ষভাবে তাদের নৈতিক যুক্তিবোধ বিকাশের পথকেও রুদ্ধ করে দিতে পারে, যেখানে প্রশ্ন করা এবং বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবা অত্যন্ত জরুরি।


শেষ কথা

দিনশেষে, হান্নান মাসুদ বা এডওয়ার্ড স্নোডেন কেবল একেকটি উদাহরণ। আসল প্রশ্নটি আমাদের প্রত্যেকের নিজের কাছে। আমরা সমাজের নানা প্রলোভন ও চাপের মুখে কোহলবার্গের নৈতিক বিকাশের কোন ধাপে দাঁড়িয়ে আছি, এবং সেখান থেকে উত্তরণের জন্য কতটা সচেষ্ট – এই আত্মজিজ্ঞাসাই হয়তো আমাদের কাঙ্ক্ষিত মানবিক সমাজ বিনির্মাণে সাহায্য করতে পারে। আমার ব্যক্তিগত দর্শন হচ্ছে – সততা মানে কোন কারণ, পুরস্কার, অজুহাত, বা ভয় ছাড়াই সৎ থাকার সক্ষমতা।

বাবা-মায়ের দেওয়া শিক্ষাই হোক, ধর্মীয় মূল্যবোধই হোক, আর মনোবিজ্ঞানীর তত্ত্বই হোক – নৈতিক বিকাশের পথে যাত্রা একটি অনন্ত যাত্রা! আমৃত্যু এই প্রচেষ্টা করে যাওয়াই হচ্ছে মানুষ হিসেবে আমাদের কাজ।

সমাপ্ত

লেখাটি ভালো লেগেছে?
অন্য কেউ জানলে উপকৃত হবে বলে মনে করেন? তাহলে শেয়ার করুন অন্যদের সাথে! 😊

এমন অনেক প্রশ্ন আছে, যেগুলোর উত্তর খুঁজতে গিয়েই আমার ভাবনার জগৎ তৈরি হয়েছে। সমাজ, রাজনীতি, মনোবিজ্ঞান, ইতিহাস — এসব বিষয়ে জানার কৌতূহলই আমাকে চিন্তা করতে শিখিয়েছে।

আমি খালিদ হাসান জীবন। পেশায় প্রোডাক্ট ডিজাইনার, কিন্তু আগ্রহের ক্ষেত্র তার চেয়েও অনেক বিস্তৃত। সমাজবিজ্ঞানে পড়াশোনা করলেও, আমার শেখার ক্ষুধা কখনো কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের গণ্ডিতে আটকে থাকেনি। ডিজাইন থেকে দর্শন, প্রযুক্তি থেকে তত্ত্ব, সবকিছু নিয়েই ভাবতে ভালোবাসি।

আমি লিখি, যখন মনে হয় কোনো ভাবনা শুধু আমার মধ্যে আটকে না রেখে অন্যদের সাথেও ভাগ করা দরকার। যদি আমার লেখা কাউকে নতুন করে ভাবতে শেখায়, প্রশ্ন তুলতে উদ্বুদ্ধ করে, কিংবা কোনো পুরোনো ধারণাকে একটু নাড়িয়ে দেয় — তাহলেই মনে হবে, লেখা সার্থক হয়েছে।

এমন অনেক প্রশ্ন আছে, যেগুলোর উত্তর খুঁজতে গিয়েই আমার ভাবনার জগৎ তৈরি হয়েছে। সমাজ, রাজনীতি, মনোবিজ্ঞান, ইতিহাস — এসব বিষয়ে জানার কৌতূহলই আমাকে চিন্তা করতে শিখিয়েছে।

আমি খালিদ হাসান জীবন। পেশায় প্রোডাক্ট ডিজাইনার, কিন্তু আগ্রহের ক্ষেত্র তার চেয়েও অনেক বিস্তৃত। সমাজবিজ্ঞানে পড়াশোনা করলেও, আমার শেখার ক্ষুধা কখনো কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের গণ্ডিতে আটকে থাকেনি। ডিজাইন থেকে দর্শন, প্রযুক্তি থেকে তত্ত্ব, সবকিছু নিয়েই ভাবতে ভালোবাসি।

আমি লিখি, যখন মনে হয় কোনো ভাবনা শুধু আমার মধ্যে আটকে না রেখে অন্যদের সাথেও ভাগ করা দরকার। যদি আমার লেখা কাউকে নতুন করে ভাবতে শেখায়, প্রশ্ন তুলতে উদ্বুদ্ধ করে, কিংবা কোনো পুরোনো ধারণাকে একটু নাড়িয়ে দেয় — তাহলেই মনে হবে, লেখা সার্থক হয়েছে।

এমন অনেক প্রশ্ন আছে, যেগুলোর উত্তর খুঁজতে গিয়েই আমার ভাবনার জগৎ তৈরি হয়েছে। সমাজ, রাজনীতি, মনোবিজ্ঞান, ইতিহাস — এসব বিষয়ে জানার কৌতূহলই আমাকে চিন্তা করতে শিখিয়েছে।

আমি খালিদ হাসান জীবন। পেশায় প্রোডাক্ট ডিজাইনার, কিন্তু আগ্রহের ক্ষেত্র তার চেয়েও অনেক বিস্তৃত। সমাজবিজ্ঞানে পড়াশোনা করলেও, আমার শেখার ক্ষুধা কখনো কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের গণ্ডিতে আটকে থাকেনি। ডিজাইন থেকে দর্শন, প্রযুক্তি থেকে তত্ত্ব, সবকিছু নিয়েই ভাবতে ভালোবাসি।

আমি লিখি, যখন মনে হয় কোনো ভাবনা শুধু আমার মধ্যে আটকে না রেখে অন্যদের সাথেও ভাগ করা দরকার। যদি আমার লেখা কাউকে নতুন করে ভাবতে শেখায়, প্রশ্ন তুলতে উদ্বুদ্ধ করে, কিংবা কোনো পুরোনো ধারণাকে একটু নাড়িয়ে দেয় — তাহলেই মনে হবে, লেখা সার্থক হয়েছে।

মনোজগত

নিয়ে আরও লেখা

এরিস্টটল থেকে গ্যালিলিওঃ আমাদের বিনাপ্রশ্নে মেনে নেওয়ার অভ্যাস এবং বায়াস অব অথরিটি | খালিদ হাসান জীবন এর ভাবনা | ব্লগ | Khalid Hasan Zibon | Blog

মনোজগত

১১ ডিসে, ২০২৪

এরিস্টটল থেকে গ্যালিলিওঃ আমাদের বিনাপ্রশ্নে মেনে নেওয়ার অভ্যাস এবং বায়াস অব অথরিটি

অথরিটির প্রতি আমাদের অন্ধ বিশ্বাস কীভাবে আমাদের ভুল পথে নিয়ে যায়?

এরিস্টটল থেকে গ্যালিলিওঃ আমাদের বিনাপ্রশ্নে মেনে নেওয়ার অভ্যাস এবং বায়াস অব অথরিটি | খালিদ হাসান জীবন এর ভাবনা | ব্লগ | Khalid Hasan Zibon | Blog

মনোজগত

১১ ডিসে, ২০২৪

এরিস্টটল থেকে গ্যালিলিওঃ আমাদের বিনাপ্রশ্নে মেনে নেওয়ার অভ্যাস এবং বায়াস অব অথরিটি

অথরিটির প্রতি আমাদের অন্ধ বিশ্বাস কীভাবে আমাদের ভুল পথে নিয়ে যায়?

এরিস্টটল থেকে গ্যালিলিওঃ আমাদের বিনাপ্রশ্নে মেনে নেওয়ার অভ্যাস এবং বায়াস অব অথরিটি | খালিদ হাসান জীবন এর ভাবনা | ব্লগ | Khalid Hasan Zibon | Blog

মনোজগত

১১ ডিসে, ২০২৪

এরিস্টটল থেকে গ্যালিলিওঃ আমাদের বিনাপ্রশ্নে মেনে নেওয়ার অভ্যাস এবং বায়াস অব অথরিটি

অথরিটির প্রতি আমাদের অন্ধ বিশ্বাস কীভাবে আমাদের ভুল পথে নিয়ে যায়?

Blog cover image

মনোজগত

২৭ ডিসে, ২০২৩

অন্যরা যেভাবে আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণকে প্রভাবিত করে: ফেইসবুক রিয়্যাক্ট থেকে শুরু করে গ্রুপ থিংকিং

অন্যরা আমাদের সিদ্ধান্তকে কীভাবে প্রভাবিত করে? গ্রুপ থিঙ্কিং কী?

Blog cover image

মনোজগত

২৭ ডিসে, ২০২৩

অন্যরা যেভাবে আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণকে প্রভাবিত করে: ফেইসবুক রিয়্যাক্ট থেকে শুরু করে গ্রুপ থিংকিং

অন্যরা আমাদের সিদ্ধান্তকে কীভাবে প্রভাবিত করে? গ্রুপ থিঙ্কিং কী?

Blog cover image

মনোজগত

২৭ ডিসে, ২০২৩

অন্যরা যেভাবে আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণকে প্রভাবিত করে: ফেইসবুক রিয়্যাক্ট থেকে শুরু করে গ্রুপ থিংকিং

অন্যরা আমাদের সিদ্ধান্তকে কীভাবে প্রভাবিত করে? গ্রুপ থিঙ্কিং কী?